ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা এক নতুন মাত্রা পেয়েছে ২০২৫ সালের এপ্রিলে শুরু হওয়া সামরিক সংঘাতে। দীর্ঘদিনের বৈরী এই দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে এই সংঘাত উপমহাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মুখে ফেলেছিল। এই প্রতিবেদনে আমরা ২০২৫ সালের এই সংঘাতের কারণ, এর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং উভয় পক্ষের হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
সংঘাতের সূত্রপাত: পহেলগাঁও হামলা
২০২৫ সালের ২২শে এপ্রিল, ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে একটি সন্ত্রাসী হামলা হয়। এই হামলায় অন্তত ২৬ জন পর্যটক নিহত হন (যার মধ্যে ২৫ জন ভারতীয় এবং ১ জন নেপালি বেসামরিক নাগরিক ছিলেন)। 'দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট' (যা লশকর-ই-তাইয়েবার সাথে যুক্ত) নামের একটি সংগঠন এই হামলার দায় স্বীকার করে। ভারত অবিলম্বে এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় কড়া সামরিক পদক্ষেপের ঘোষণা দেয়।
'অপারেশন সিঁদুর' ও 'বুনইয়ান-উন-মারসুস': পাল্টাপাল্টি হামলা
পহেলগাঁও হামলার পর, ভারত ৭ই মে মধ্যরাতে 'অপারেশন সিঁদুর' নামে পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালায়। ভারতের দাবি ছিল, তারা পাকিস্তানের ৯টি লক্ষ্যবস্তুতে (বিশেষ করে 'সন্ত্রাসী ক্যাম্প') অন্তত ২১টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এতে ৭০ জনের বেশি সন্ত্রাসী নিহত এবং ৬০ জন আহত হয়েছে বলে ভারত দাবি করে।
এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান 'বুনইয়ান-উন-মারসুস' নামে পাল্টা অভিযান শুরু করে। পাকিস্তানের দাবি, তারা ভারতের ভূখণ্ডে অন্তত ২০টিরও বেশি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে সফলভাবে আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে উধমপুর ও শ্রীনগর বিমানঘাঁটিতে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলেও পাকিস্তান দাবি করে।
ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি: সামরিক ও বেসামরিক জীবন
এই স্বল্পকালীন কিন্তু তীব্র সামরিক সংঘাত উভয় দেশেই ব্যাপক সামরিক ও বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি ডেকে এনেছে।
১. মানবিক বিপর্যয়: মৃতের সংখ্যা
উভয় দেশের পক্ষ থেকে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দেওয়া হয়েছে, যা প্রায়শই সংঘাতে দেখা যায়।
- ভারতের দাবি: ভারতের মতে, পাকিস্তানের হামলায় তাদের কমপক্ষে ৫ জন সেনা নিহত হয়েছেন এবং ১৬ জন বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ৫ জন জওয়ান আটক হয়েছেন বলেও দাবি করা হয়।
- পাকিস্তানের দাবি: পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় অন্তত ৪৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন এবং ৫৭ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে, বাহাওয়ালপুরের পূর্ব আহমেদপুরের একটি মসজিদে হামলার ফলে ১৩ জন শহীদ হয়েছেন বলে জিও নিউজের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের মধ্যে শিশু ও নারীও ছিলেন। পাকিস্তান আরও দাবি করেছে যে ভারতীয় হামলায় তাদের ১১ জন সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন এবং তারা একাধিক ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে।
সংঘাতের সামগ্রিক মৃতের সংখ্যা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে সুনির্দিষ্ট ও নিরপেক্ষ তথ্য পাওয়া কঠিন। তবে, দুই দেশের দেওয়া তথ্য একত্রিত করলে দেখা যায়, ৫০ থেকে ১০০ জনেরও বেশি মানুষ এই সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বেসামরিক নাগরিকও ছিলেন।
২. অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষতি
এই সামরিক সংঘাত উভয় দেশের অর্থনীতিতেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে:
- ভারতের ক্ষয়ক্ষতি:
- উত্তর ভারতের আকাশসীমা বন্ধ থাকায় প্রতিদিন প্রায় ৮ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৮৮ কোটি টাকা) বিমান চলাচলে ক্ষতি হয়েছে।
- ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) বন্ধ হওয়ায় প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা) আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
- সামরিক অভিযানে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ১১০০ কোটি টাকা) ব্যয় হয়েছে।
- যুদ্ধবিমান হারিয়ে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৪৪০০ কোটি টাকা) ক্ষতি হয়েছে।
- লজিস্টিক ও বাণিজ্য খাতে ক্ষতির পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা) ছাড়িয়ে গেছে।
- পাকিস্তানের ক্ষয়ক্ষতি:
- পাকিস্তানের মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় চার বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা) বলে অনুমান করা হয়েছে।
- করাচি শেয়ারবাজারে সূচক পড়ে যাওয়ায় প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ২৭৫০ কোটি টাকা) ক্ষতি হয়েছে।
- সামরিক অবকাঠামো, মসজিদ এবং আবাসিক এলাকায় হামলার কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
বিশ্বের প্রথম 'ড্রোন যুদ্ধ'
এই সংঘাতটিকে দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে প্রথম ড্রোন যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উভয় পক্ষই একে অপরের স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন ব্যবহার করেছে, যা আধুনিক যুদ্ধের এক নতুন এবং বিপজ্জনক দিক উন্মোচন করেছে।
যুদ্ধবিরতি ও ভবিষ্যৎ সম্পর্ক
কয়েক দিনের তীব্র সংঘাতের পর, ১০ই মে, ২০২৫ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। এই যুদ্ধবিরতি সাময়িকভাবে পরিস্থিতি শান্ত করলেও, কাশ্মীর সমস্যা এবং সীমান্ত উত্তেজনা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় দুই দেশের সম্পর্ক এখনও বেশ জটিল। ২০২৫ সালের নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচের মতো ঘটনাগুলো উভয় দেশের জনগণের মধ্যে কিছুটা ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করলেও, সামগ্রিক রাজনৈতিক সম্পর্ক এখনও অনিশ্চিত।
উপসংহার
২০২৫ সালের ভারত-পাকিস্তান সংঘাত আবারও প্রমাণ করেছে যে, পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে যেকোনো সামরিক সংঘর্ষ কতটা ধ্বংসাত্মক হতে পারে। এই সংঘাত কেবল বহু মানুষের জীবন কেড়ে নেয়নি, বরং উভয় দেশের অর্থনীতিতেও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের পথ খুঁজে বের করা অত্যন্ত জরুরি।
Disclaimer: এই প্রতিবেদনটি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও উইকিপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। সংঘাতের সময় বিভিন্ন পক্ষের দেওয়া তথ্যে ভিন্নতা থাকতে পারে।